বাঁদনা পরব এর ইতিকথা
বাঁদনা আদিবাসী টোটেমিক কুড়মি জনজাতির অন্যতম প্রধান উৎসব। এর প্রধান উদ্দেশ্য চাষবাস শেষ হওয়ার পর ও নতুন করে চাষের মরশুম শুরু হওয়ার প্রায় মাঝামাঝি সময়টিতে মূলতঃ কৃষিকাজে ব্যবহৃত বলদ-মহিষকে তাদের আলস্যের ভাব কাটিয়ে তোলা। অন্য উদ্দেশ্যটি আজকের দিনে অপ্রাসঙ্গিক হলেও কয়েক হাজার বছরের ঐতিহ্যকে ধরে রাখা । ঐতিহ্যবাহী দ্বিতীয় উদ্দেশ্যটির ভিত্তি হল – কৃষিজীবী কুড়মিরা যখন গবাদি পশুকে বনে জঙ্গলে চরানোর জন্য নিয়ে যেতেন, তখন প্রায়শঃই সেগুলিকে (বিশেষতঃ বাছুরকে) বাঘ ও অন্য হিংস্র বন্যপশুর আক্রমনের মুখে পড়তে হত। “গাইকা পুতা ভালা সিসু বালক গউ, মহিসেক পুতা ডামাল ; (অরে)বাঘেক পুতা ভালা দমে বলিমান গউ, রগদাঁই ধরএ ধেনু গাই” –এই প্রাচীন সহরই (বাঁদনা) গীতটি তারই প্রমাণ দেয়। দীর্ঘ পর্য্যবেক্ষণের ফলে কুড়মি জনজাতির মানুষেরা উপলব্ধি করেছিলেন, হিংস্র বন্য পশুর আক্রমণ থেকে তাঁদের নিজেদের পক্ষে গবাদি রক্ষা করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। তাই তাঁরা পদক্ষেপ নিয়েছিলেন – গবাদি পশুগুলির মধ্যে বলবান অংশটিকে (ষাঁড় বা বলদ)আত্মরক্ষার কসরৎ শেখানোর জন্য। অতীতে বাঘের বা নেকড়ের চামড়া বলদকে খুঁটিতে বেঁধে তার নাকমুখের সামনে রেখে সেই পশুটির গায়ের গন্ধ বলদটিকে চেনানো ছাড়াও তাকে ইঁড়কাই বন্যপশুর আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য শিং ও দেহশক্তির প্রয়োগের কেরামতি শেখানোর রীতিই বাঁদনার সূত্রপাত করেছিলেন। “ভালা অহিরে – এতদিন জে খাওআলি বঝা বঝা ঘাঁসঅরে অহিরা, আইজঅ তহর দেখিবঅ মদদানি রে”।এই গীতে সেই উদ্দেশ্য প্রকট। বাঘের চামড়ার অভাবে বর্তমানে গরুমোষের চামড়াই (Hide) ব্যবহৃত হয়।
প্রথম উদ্দেশ্য অত্যন্ত নিবিড়ভাবে সমাজবিজ্ঞান ও নৃবিজ্ঞানসম্মত । কৃষিজীবী কুড়মি জনজাতির জীবনজীবিকায় বলদ-গাইয়ের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ওগুলি ছাড়া কৃষিকাজ সম্পন্ন করা অসম্ভব ছিল। তাই “গরইআ” বা “গহাইল”পুজার মাধ্যমে গো-ধনকে মাতৃশ্রদ্ধায় পুজা করা হয় ।পুজার কোন মন্ত্র নেই, নিজেরাই পুজারী। মনে মনে যে মন্ত্র বলা হয় তা হল “সুস্হ নিরোগ থাক। দুধ ঘি দাও, গবরসার দাও, হাল টান গাড়ি টান গতর লাগাঁই, হামদিককে বাঁচাঁই রাখ’ । উপাচার – শালুক ফুল আর নৈবেদ্য হল চালের গুঁড়ি জলছাড়া দুধে গুলে বাড়ীতে তৈরী বিশুদ্ধ ঘিয়ে ছেঁকে তৈরী করা পিঠা।
বাঁদনার প্রথমদিনে ভাল করে স্নান করিয়ে শিংএ সরষের তেল মাখানো ও শিং ভর্তি সিঁদুরের তিলক লাগানো, সারা গায়ে নিজের টোটেমের চিহ্ন রং দিয়ে এঁকে দেওয়া, দুই শিং বরাবর ধানের শিসের মোড় (মুকুট) পরানো, গলায় বুনো ফুলের মালা পরানো হয় এবং তারপর সপরিবারে ভক্তিভরে গরু চুমানো ও পুজা করা হয়। সেইদিনের রাত্রিবেলা (অমাবস্যা) সারা রাত গাই গরুকে ঘুমাতে দেওয়া হয় না, জাগিয়ে রাখা হয়। গরু-জাগরনের রাতে ধাঙইড়ারা (গরু জাগানোর দল) বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে সহরই গীত গাহে প্রতিটি কৃষকের বাড়ীতে ঢুকে ।সঙ্গে থাকে ঢোল, ধামসা, মাদল্ করতাল, সাহনাই, পেঁপতি, টিনভাঙ্গা ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র। গহাইলের সামনে যখন গীত গাহা হয় তখন বাদ্য বন্ধ থাকে আর গীতের শেষ শব্দটি উচ্চারিত হওয়ার সাথে সাথে সকলে “কুলকুলি” (মুখের ওষ্ঠ ও হাতের তালুর সাহায্য একপ্রকার চীৎকারমূলক শব্দ)দিয়ে সব বাদ্য একসাথে “গিজজি গিজিং গিজিগিন, গেজাক গেজাক গিজিগিন”- এই বোলে বাজতে থাকে পুণরায় গীত শুরু না হওয়া অবধি। যথারীতি এই বিকট অথচ ছন্দমধুর আওয়াজে গরুবলদের ঘুমানোর উপায় থাকে না। তাছাড়া সারা রাত গুহাইলে ঘিএর প্রদীপ জ্বেলে আলোকিত রেখে ও মাঝে মাঝেই খড়-ছানি খেতে দিয়েও জাগিয়ে রাখা হয়। পরদিন দুপুরের পর বুঢ়ি বাঁদনা পালনের জন্য গরুখুঁটা ও কাড়াখুঁটা উৎসব-অনুষ্ঠান হয়।
এবার আরো একটু ভেতরে জাই
“সুইনেছি ভাদরের কাঁদনা
আসছে পরব মকর বাঁদনা”
আসছে পরব মকর বাঁদনা”
আদিবাসীরা রাই(খামিদ/মালিক),রইয়া (খামিধান/মালকিন) কৃষিকাজে বরদা/বলদের সাহায্যে সম্পন্ন করে বলে সহযোগী বরদাকে ঊৎসাহিত ও সম্মান দেওয়ার জন্য সোহরাই বা বাঁন্দনা পরব পালন করে।
সেই সঙ্গে বরদার মা অর্থাৎ গাইয়েরও পূজা হয়। কারন গাই ছাড়া বরদা কি খরে আসবে? তাই গাইকে কৃতঞ্জতা জানাতে গরইয়া পূজা হয়।
কুড়মালি শাসন ব্যবস্হায় রাই/রইয়ার প্রচলন আদি কাল থেকেই। সে জন্য বরদার বাঁদনা, সহরাই আর গাইয়ের গোরইয়া করে সম্মান জানানো হয়।
সেই সঙ্গে বরদার মা অর্থাৎ গাইয়েরও পূজা হয়। কারন গাই ছাড়া বরদা কি খরে আসবে? তাই গাইকে কৃতঞ্জতা জানাতে গরইয়া পূজা হয়।
কুড়মালি শাসন ব্যবস্হায় রাই/রইয়ার প্রচলন আদি কাল থেকেই। সে জন্য বরদার বাঁদনা, সহরাই আর গাইয়ের গোরইয়া করে সম্মান জানানো হয়।
বাঁদনার 11 পর্ব।
1.তেলদেওয়া
2.গঠপূজা
3.জাগান
4.জাগান বা ঝাঁগড
5.গহাল পূজা
6.চূমান
7.কাঁচিজিওরি
8.চৈখপূরা
9. নিমছান
10.গরুখুঁটা
11.কাঁটা কাড়হা
2.গঠপূজা
3.জাগান
4.জাগান বা ঝাঁগড
5.গহাল পূজা
6.চূমান
7.কাঁচিজিওরি
8.চৈখপূরা
9. নিমছান
10.গরুখুঁটা
11.কাঁটা কাড়হা
প্রতিটা নেগে 11 টা নিয়ম আছে। যেমন বিহাঘর মরাঘর ইত্যাদি তে বিভিন্ন নেগ ব্যবহার হয়।প্রতিটি নেগাচারের পিছনে বৃহৎ অর্থ লুকিয়ে আছে।যা আমরা অনেকেই এই বৃহৎ অর্থকে জানার চেষ্টা করি না,আবার জানলেও গুরুত্ব দিই না।কিন্তু আপনারা মনে করে দেখবেন অহিরা গীত মানে শুধু মাদৈল থাপড়া নয়,এর মধ্যদিয়ে বহু তথ্য তুলে ধরা হয়। সমস্ত ছোটনাগপুরের লক্ষ লক্ষ কুড়মি আদিবাসীর পরব বাঁন্দনা।
আসুন আমরা প্রতিজ্ঞা করি আমাদের ঐতিহ্য, বিশ্বাস, ধর্ম, ইতিহাস, ভাষা এবং সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখবোই।
জহার
সুত্র সহযোগীতা:
অনাদি কুমার মাহাত
Post a Comment