টুসু পরব: ছোটনাগপুরের শ্রেষ্ঠ উৎসব!!
লিখেছেন -মৃন্ময় বঁসরিয়ার
শীত মানেই পার্বণ, শীত মানে পৌষ মেলা, শীত মানেই জমিয়ে খাওয়া দাওয়া। শীত মানেই ভ্রমণ, কুহুভাত, ডিবুভাত, বনভোজন, পিকনিক। শীতে গঙ্গাসাগর মেলা, জয়দেবের মেলা অপামর ভারতবাসীর আকর্ষণের অন্যতম কারন। বাঙালিদের নবান্ন উৎসব এই পৌষেই, মকর সংক্রান্তিতে মকর স্নান, বাড়িতে বাড়িতে লক্ষীর আরাধনা, আলপনা, পিঠে-পার্বণ- সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু কেউ মনে রাখেনা এই “পৌষ পরবের স্রষ্টা” আদিবাসী সমাজকে।
ভারতবর্ষের সবচেয়ে অনুন্নত, জঙ্গলময়, পর্বতবেষ্টিত ছোটনাগপুর মালভূমি । সরস গাঙ্গেয় সমতল থেকে পৃথক ভূপ্রকৃতি এবং নৃতাত্ত্বিক সামাজিক বিশিষ্টতা এই অঞ্চলকে যে স্বাতন্ত্র্য দান করেছে সেই স্বাতন্ত্র্যই তাকে আজও আধো-চেনা করে রেখেছে। কৃপণ প্রকৃতি, বিস্তীর্ণ ঊষরতা, শীততাপের তীব্রতা - এসবের সঙ্গে অনবচ্ছিন্ন সংগ্রামে নিরত এখানকার প্রধানত কৃষিনির্ভর কুড়মি আদিবাসী জনজীবন।
সংগ্রামে যেমন ধরা দেয় লোকজীবনের দুর্দম প্রাণস্পন্দন, লোক-উত্সবে তেমনই ধরা দেয় তার স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণোচ্ছ্বাস। নিরন্তর সংগ্রাম আর বঞ্চনার ব্যথা শাল, মহুল, পলাশ, কুসুমের দেশের মানুষের প্রাণের সেই উচ্ছ্বাস দমন করতে পারেনি। টুসু, করম, বাঁদনা, ইঁদ, জিতা, চড়ক, পরব বা শিকার পরব - নানা উত্সব, পরবের আনন্দ দিয়ে দৈনন্দিন দুঃখগুলো মুছে ফেলতে জানে এখানকার মানুষ।
গাঙ্গেয় বঙ্গের প্রধান উৎসব দুর্গাপুজো যে উদ্বেলতা সৃষ্টি করে, সমগ্র ছোটনাগপুরে তা অনেকাংশে নিস্তেজ। যে উৎসব এখানে আরও বেশি গুরুত্ব পায়, যে উৎসবে এই ভূখণ্ডের গভীর, বর্ণময় স্বতোত্সার ধরা পড়ে সবচেয়ে বেশি তা হল টুসু পরব।
এই উত্সব পৌষালি ফসলের উৎসব, নানা লোক-উৎসবের মতোই কৃষিকেন্দ্রিক, বিদ্বজ্জনের মতে, ফার্টিলিটি রিচুয়াল অর্থাত উর্বরাশক্তির উপাসনা। এই পুজোর পুরোহিত নেই, নেই পূজন-মন্ত্র। এই পুজো মূলত মেয়েরাই করে, পূজন-মন্ত্র হল গান। গানের ভাষা শহুরে মানুষের সুমার্জিত, সুসংস্কৃত, কৃত্রিম ভাষা নয়। এ ভাষা সহজ, সরল লোকজীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সুখ-দুঃখ, বাৎসল্যরস, প্রেম-বিরহ, ঈর্ষা-অভি ফুটে ওঠে চাকচিক্যহীন ভাষায়। পৌষ মাস শিশির-সিক্ত নতুন ফসলের মাস। কৃষকের সেই আনন্দ উচ্ছলিত হয় টুসু উৎসবে। টুসু গাঙ্গেয় সমভূমির স্বর্গবাসিনী শ্রেণীর নন, নেহাতই ঘরের মেয়ে, গিরিরাজকন্যা মহামায়ের কাছাকাছি। অসুরদলনী, সিংহবাহিনী, দশপ্রহরণধারিণী দুর্গা থেকে শত মাইল দূরে।
এই সময় সমগ্র ছোটনাগপুর জুড়ে আকাশে বাতাসে টুসুগানের মেঠো সুর ধ্বনিত হয়, এই লোকগানের সুরে মুগ্ধ হওয়ার সেরা সময় তো এটাই। কিন্তু এর বেশি পরিচিতি নেই, চাকচিক্য নেই, শহুরে হুল্লোড় নেই- তবু মানুষগুলোর প্রানের উৎসব টুসু, এই উৎসব মাটির উৎসব। নিজগুণে এক ঘরের মেয়ে -সমগ্র নারীকুলর প্রতীক হয়ে ওঠে, টুসু মানব ও প্রকৃতির এক মিলিত বিগ্রহ। মুলতঃ টুসু আসলে কৃষিভিত্তিক আঞ্চলিক পার্বণ ।
মূল আকর্ষণ এক মাস ধরে গাওয়া টুসু গান, সন্ধ্যা নামলেই সমবেত কন্ঠে গায় পূজারিণীরা। এরপর আসে পৌষ সংক্রান্তি। পৌষের শীতল রাতে, পাড়ার মেয়ে-বউরা সুরের মূর্চ্ছনায় জাগিয়ে রাখে রুখামাটির গ্রামগুলোকে। বক্স, লাউড স্পিকারে বাজতে থাকে এসব গান। টুসু গানের কথায় ফুটে ওঠে ছোটনাগপুরের সামাজিক চিত্র, সুখ-দুখের কাহিনী। টুসু জাগরণের রাত বাঁউড়ি নামে পরিচিত।
একটা বিখ্যাত টুসু গানের কথা শুনলেই বোঝা যায় টুসু তাদের ঘরে মেয়ে।
-"চল টুসু চল খেলতে যাবো, রানীগঞ্জের বটতলায় ।।
খেলতে খেলতে দেখে আসবো কয়লা খাদের জল তুলা ।
হলুদ বনের টুসু তুমি হলুদ কেন মাখো না ।।
শাশুরি-ননদির ঘরে হলুদ মাখা সাজ না ”
ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর ও পশ্চিম রাঢ়ের বাঁকুড়া, পুরুলিয়া ছাড়াও বিহারের ধানবাদ, সিংভূম এই উত্সবের ব্যাপ্তি হলেও উৎসবের প্রাণকেন্দ্র হল পুরুলিয়া। তুষু, টুসু, তোষলা, তোষালি, মকর ইত্যাদি নানা নামে এর পরিচয়। অগ্রহায়ণ সংক্রান্তিতে উৎসবের উদ্বোধন এবং এক মাস পরে পৌষ সংক্রান্তিতে তার সমাপন।
স্থাপন,পালন, জাগরণ ও বিসর্জন। উত্সবের সমগ্র বিস্তারটির চারটি পর্ব। অগ্রহায়ণ সংক্রান্তিতে বাড়ির আঙিনা বা অন্য কোনও উপযুক্ত স্থানে আলপনা এঁকে সেখানে টুসুকে স্থাপন করা হয়। পৌষ মাসের প্রতিদিন সেখানে প্রদীপ দেওয়া হয়। টুসুর ঘুম ভাঙিয়ে চিঁড়ে, মুড়ি, গুড়, মণ্ডা ইত্যাদি উৎসর্গ করা হয়। অনেক রাত ধরে চলে মেয়ে-বউদের গান। তার পরদিন সন্ধ্যা টুসুকে ঘুম পাড়ানো হয়। এটা হল পালন পর্ব। পৌষ-সংক্রান্তির আগের রাত হল জাগরণের রাত। রাত ধরে গানে গানে হয় পুজোর অনুষ্ঠান। পৌষ-সংক্রান্তির দিন টুসুর বিসর্জন। এবং পরের দিন তারা নতুন কৃষিবর্ষকে বরন করে।
পুজোর উপচারও সরল। পোড়া মাটির সরার চারপাশে জ্বলে মাটির প্রদীপ। পিটুলি গোলা দিয়ে সরার গায়ে আঁকা হয় নানা চিত্র। সরার ভেতরে থাকে নতুন ধান, তুষ মেশানো নাড়ু, গোবরের দলা।সরা সাজানো হয় ফুল, ফুলের মালা, কড়ি, কুঁচ, সরষে ইত্যাদি দিয়ে। সরার বদলে কেউ কেউ ঘটও ব্যবহার করে। কেউ আবার সরার ওপরে ঘট বসায়। এই-ই হল টুসু। আজকাল মূর্তি গড়েও পুজো করছে অনেকে যা কুড়মালী সংস্কৃতি বিরুদ্ধ। ছোট হলুদ রঙের মূর্তি, পরনে লাল বাঃ নীল শাড়ি। মাথার পেছনে জ্যোতির্বলয়। বিসর্জনের দিন চোড়লের ভেতরে সরা বসিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় নদীতে বা বাঁধে।
চোড়ল বা চৌড়োল বা চৌডোল অর্থাত চতুর্দোলা টুসু পুজোর এক অপরিহার্য অঙ্গ। বাঁশের বাখারি বা চেলা কাঠ আর গাছের সরু ডাল দিয়ে তৈরি খাঁচার ওপর রঙিন কাগজ মুড়ে নানা নকশা আর কাগজের ফুলে-মালায় সাজিয়ে তৈরি করা হয় এক চমত্কার চারপায়া রথ।
পৌষ-সংক্রান্তির কয়েক দিন আগের থেকেই চোড়ল বিক্রি শুরু হয়। টুসু পুজোর সবচেয়ে বর্ণাঢ্য অংশ বিসর্জনের দিন সকালে চোড়ল নিয়ে শোভাযাত্রা। টাঁড়, ডহি-ডুংরি পেরিয়ে, পায়ের-পাতা-ডোবা ধুলো বাতাসে উড়িয়ে, উঁচু-নিচু আলের পথ ভেঙে লাল-নীল-সবুজ-হলুদ শাড়ি-জামা পরা মেয়েদের চোড়ল মাথায় নিয়ে গান গাইতে গাইতে নদী বা বাঁধের দিকে শোভাযাত্রা এক অনুপম চিত্তহারী দৃশ্য রচনা করে। এক দলের সঙ্গে আরেক দলের দেখা হলে গান আরও উচ্চগ্রামে ওঠে এবং গানের লড়াই শুরু হয়ে যায়। দুই টুসুতে সই পাতানো হয়। আবার কার টুসু কত গুণের তাই নিয়ে বিবাদও হয়। সবই গানে গানে। বিসর্জন ঘাটের পথে শোভাযাত্রা করে গানে গানে এগিয়ে যায় সবাই। ঘরের মেয়েকে বিদায় জানানোর পালা, শোকবিহ্বল হয়ে পড়ে গ্রাম্য নারীরা। চোখের জলে আত্মমর্যাদার প্রতীক নয়ণের মনি টুসুকে বিদায় জানায় ভূম। গানের ভাষাতেই সেই দুঃখ ফুটে ওঠে।
" আমার টুসু ধনে
বিদায় দিব কেমনে
মাসাবধি টুসুধন কে
পুজেছি যতনে।
শাঁখা সাড়ি সিঁদুর দিলাম
আলতা দিলাম চরণে।
মনে দুঃখু হয় বড়
ফিরে যাতে ভবনে
দয়া কইরে আসবে আবার
থাকে যেন মনে
ভুইলনা ভুইলনা টুসু
আসবে আমার সনে।"
চোড়ল সহ টুসুর বিসর্জন এবং মকরস্নান হয় কাছাকাছি নদী বা বাঁধে। বাঁধ হল বড়ো জলাশয়। মেয়েরা শুধুই চোড়ল বিসর্জন দেয়। সরা বা ঘট ঘরে রেখে দেওয়া হয় এক বছর। একে বলা হয় লক্ষ্মী বাঁধা। লক্ষ্মীকে বেঁধে রাখা হয় ঘরে। চোড়ল বিসর্জন না দিয়ে আবার সেটা ভেঙে টুকরোগুলো ভাগাভাগি করে নেয়। কেউ কেউ আবার চোড়ল ঘরে ফিরিয়েও নিয়ে যায়।
বিসর্জনের দিন নদীর পারে বা বাঁধের পাশে মেলা বসে। বাংলা-বিহার সী্তে সুবর্ণরেখার বাংলা-বিহার সী্তে সুবর্ণরেখার তীরে তুলিনে, কাঁসাই নদীর তীরে দেউলঘাটায়, শীলাবতী নদীর উত্সস্থলে, জয়দা, সতীঘাট প্রভৃতি জায়গায় বসে জমজমাট মেলা।
মকর/টুসু পরবের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল পুলি-পিঠে। নানা রকমের পিঠের মধ্যে সবচেয়ে রসনালোভন হল বাঁকা পিঠা/পুর পিঠা/ গড়গড়্যা পিঠা। বিসর্জনের শেষে বাড়ি ফিরে খাওয়া হবে পিঠে। পিঠে ছাড়াও সচ্ছল মানুষের খাদ্য-তালিকায় থাকবে খাসির মাংস আর খিচুড়ি। উৎসবের উত্স নিয়ে নানা মুনির নানা মত। এসব ভাবনা বিদ্বৎকুলের জন্যই সংরক্ষিত থাক। এই মল্লভূমিতে পদার্পণের স্পর্ধা আমার নেই।
দেশের ক্ষীণতোয়া অথচ প্রাণদ নদীর মতোই দীর্ঘকাল ধরে প্রবাহিত প্রাণোচ্ছ্বল এই উৎসবের ধারাটি আজ হয়তো কালের প্রভাবে কলুষমুক্ত থাকতে পারছে না। সংক্রমিত হয়েছে হিন্দুত্ববাদ, দেবতায়ন, সভ্য সমাজের হিনমন্যতা, সচেতন হীনতা, অবহেলা, বারোয়ারি পুজোর উচ্ছৃঙ্খলতা, মাইকের উৎপাত, মত্ত কুৎসিত তাণ্ডবনৃত্য। তবু আশা করব, সব কিছু খুইয়েও আমরা যেমন শুভ সময়ের আশা করি, স্থানীয় লোকসংস্কৃতির এই সুন্দর ধারাটি সময়ের চোরা বালিতে তলিয়ে যাবে না।
জীবনের সাথে প্রতিদিন লড়াই করতে থাকা মানুষগুলোর জীবনে টুসু পরব এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। তবে রুখামাটির দেশেও বিশ্বায়ণের ছোঁয়া, একটু যেন ফিকে হয়ে যাচ্ছে টুসু পরব। বেঁচে থাকুক টুসু পরব। টুসু গানে পৌষের কনকনে সন্ধ্যাগুলো জমে উঠুক। শহুরে ফটোগ্রাফারদের আজকাল ভিড় জমে টুসু বিসর্জনের ঘাটগুলোয়। সবাইকে আমন্ত্রন করবো ঘুরে আসুন শুখামাটির দেশে, হারিয়ে যান লোকগানে, গ্রাম্য উৎসবে।
জহার 🙏
Post a Comment