ছোট নাগপুর মালভূমির চাষবাস সংক্রান্ত কিছু রীতিনীতি বা সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা।



🔸🔸🔸🔸🔸🔸🔸🔸🔸🔸🔸🔸🔸👉ছোটনাগপুর মালভূমির কুড়মি চাষি সম্প্রদায়ের চাষবাস সংক্রান্ত কিছু রীতিনীতি বা সংস্কার ও কুসংস্কার প্রচলিত আছে। বংশ পরম্পরায় সেই সংস্কারগুলি আমার পালন করে আসছি। কিন্তু এগুলির পিছনেও যে বৈজ্ঞানিক যুক্তি আছে তা আমরা নিজেও জানি না। তবে যারা শুক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ করবেন তারা অবশ্যই বুঝতে পারবেন। আমার জানা কিছু রীতিনীতি বা সংস্কার ও কুসংস্কারের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করবো। এ আমার সম্পূর্নই নিজস্ব অভিজ্ঞতা। অনেক ভুল ভ্রান্তি হতে পারে। যদি ভুল থাকে মন্তব্যে যুক্তিযুক্ত উত্তর দিলে অশেষ উপকৃত হবো। তাছাড়াও স্থান ভেদে আরো অনেক প্রচলিত রীতিনীতি আছে তাও উল্লেখ করতে পারেন যথাযথ উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো। আমি না পারলেও আরো অনেকের নজরে আসবে তারাও উত্তর দিতে পারেন। এতে আমিও ঋদ্ধ হবো। তাহলে শুরু করি বর্তমান সময় থেকেই।

#মুঠি_ধান_আনা_হয়_কেন?

=ধান কাটা শুরু করার আগেই মুঠি ধান এনে খামারে রাখা হয়।এতে পরীক্ষা করা যায় খামার ঠিক মতো জীবানু মুক্ত হয়েছে কি না। বার বার গোবর লেপে আমরা খামারকে জীবানু মুক্ত করি। তাতে উই পোকার আক্রমন থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। আবার ইঁদুরের উপদ্রবও জানা যায়।

#প্রথম ধান বা মুঠি ধান পুরুষেরাই কাটে কেন?

=আদিম কাল থেকে চাষবাস ছিল পুরুষ কেন্দ্রীক।ঘরের বাইরের কাজ পুরুষ করতো আর ঘরের কাজ মহিলারা করতো। চাষের শুরু থেকে অর্থাৎ বীজতলা (বিহন গাঢ়ি) তৈরী থেকে ডিনিমাঞ (ঠাকুর মাঞ) আনা পর্যন্ত, ধান ঝাড়া থেকে ঘরে ঢুকানো পর্যন্ত সমস্ত কাজ পুরুষেরাই করতো। পরে পরে মহিলারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। এমনকি এখন চাষের কাজটা বেশী ভাগ মহিলা দ্বারাই হচ্ছে পুরুষেরা শুধু নিয়ম পালনটা করেছেন। আর একটা ধর্মীয় বিশ্বাসও কাজ করে এই কুসংস্কারটার পিছনে। অনেকেই অভিশাপ দিয়ে থাকে "আমার ধান যে কাটবে তার অমুক তমুক রোগ হবে"। তাই কাজের লোকেরা প্রথমে কাটতে চাই না।ঘরের কেউ শুরু করে দিলে সেই দোষ খন্ডণ হয়ে যায়। এই ধরনের কুসংস্কারও হতে পারে।

#ডিনিমাঞ বা ঠাকুর মাঞ রাখা হয় কেন?

=ডিনিমাঞ বা ঠাকুর মাঞ রাখার পিছনে দুটি যুক্তি আছে।
প্রথমত যখন প্রায় প্রায় সবারই ধান কাটা হয়ে যায় সেই সময় কোন একটা শুভদিন দেখে গ্রামের অধিকাংশ ঘরে ডিনিমাঞ আনে। এবং সেই সকল ঘরে  পিঠা করে মাংস রান্না করে। এতে সবার সঙ্গে একটা সুসম্পর্ক বজায় থাকে। সবাই মিলে একটা উৎসবের দিন পালন করে।
দ্বিতীয়ত এই কারণটাকেই আমি আসল মনে করি। ধান ঝাড়াই করার সময় কুপি(মাটির ছোট মুখের পাত্র) রাখা হয় সেটাও এই কারণেই। 
বর্তমান যুগের মতো আগে চাষের কাজে এতটা সুবিধা ছিল না। এখন প্রতি বছর ধান বীজ কিনে বিহন করা হয়। আগে বিহনের ধান নিজেকেই রাখতে হতো। ছোট নাগপুর মালভূমির চাষবাস সম্পূর্নই বৃষ্টি নির্ভর। অতীত মানুষকে অনেক বার খরার সম্মুখীন হতে হয়েছে। পরের বছর বৃষ্টিপাত হলো না। তখন জীব ধানকেই চাল করে খাওয়া হয়ে গেল। তার পরের বৎসরের জন্য ধান কারো কাছে নেই।তখন এই ডিনিমাঞ ও কুপির ধান থেকেই পুনরায় ধান চাষ করা যেত। অর্থাৎ ধান পুরোপুরি লুপ্ত হওয়া থেকে রক্ষা করা যেত।

#ধান ঝাড়ার সময় মাচার নিচে হাঁসুয়া (কাস্তে) রাখা হয় কেন?

=কথাটা বাবার মুখে শুনেছিলাম।ছোট নাগপুর মালভূমি এলাকাতেই কিছু নিম্ন জাতির মানুষ বাস করতো  তাদেরকে চিলহর আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। ধান ঝাড়াই করে পরিস্কার  করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে গেলে
একটু সুযোগ পেলেই তারা  ঝুড়ি ভর্তি ধান নিয়ে  পালিয়ে যেত। তাদের আক্রমণ থেকে বাঁচতে অস্ত্র রূপে কাস্তে রাখা হতো।

#ধান তুলার জন্য যে সকল ঝুড়ি ও কুলা ব্যবহার করা হয় সেগুলোতে তুলসী পাতার জল ছিটা দিতে হয় কেন? 
এবং ধুনা জ্বালিয়ে ঝুড়িতে ধুনা ভর্তি করে ধানের উপরে ছড়ানো হয় কেন?

=প্রতিটা ভালোর সাথে কিছুটা খারাপ থাকে।ধানের সাথে আসে বিভিন্ন প্রকার রোগ জীবাণু।
জেনে আশ্চর্য হতে হয় সেই আদিম যুগের মানুষেরা বিনা পরীক্ষাগারে আবিস্কার করে ছিল ধানের সাথে বিভিন্ন প্রকার রোগ জীবাণু ঘরে চলে আসে। এবং তারা এটাও আবিস্কার করেছিল তুলসী পাতার জল ও ধুপের ধুঁয়াতে জীবাণু নাশক ক্ষমতা আছে। সেই কারণেই তুলসী পাতার জল ছিটা ও ধুনার ধুঁয়া দিতে হয়।

#ধান মাপার সময় কথা বলতে নেই কেন?

=ধান ঝাড়ার পর পরিস্কার করে ঝুড়িতে মেপে ঘরে ঢোকানো হয়।যখন ধান মাপা হয় তখন কথা না বলার কারণ চাষীরা বেশীর ভাগ অশিক্ষিত হলেও সম্পূর্ণ বৎসের খাদ্য সম্পরকে সচেতন ছিল। কারণ এই অর্জিত ধান এক বৎসর কালাতিক্রম করতে হবে। আর এর থেকে আগামী বৎসরের বীজ রাখতে হবে। তাই মনোযোগ সহকারী গুনতি করে ধান তোলা হতো। কথায় কথায় অনেক সময় হিসাব ভুল হয়ে যেতে পারে। পরিমান অনেক বেশী হওয়ায় দ্বিতীয় বার মাপাও কষ্টসাধ্য। সেই কারণেই ধান মাপার সময় কথা বলা বারণ।

****************************************

✍️ মুলচাঁদ মাহাতো

আজ এতটাই আপনাদের নিজ নিজ এলাকায় আরো যে সকল রীতিনীতি প্রচলিত আছে মন্তব্যের ঘরে উল্লেখ করুন সবার যথাসাধ্য উত্তর নিয়ে পরের সংখ্যায় হাজির হবো।

1 comment:

  1. নাগপুর নামের" নাগ"নামের মধ্যে কিছু রহস্য লুকিয়ে আছে আমার মনে হয়।

    ReplyDelete